রাতের আকাশে চোখ রেখে বিস্মিত হই আমি, বিস্মিত হও তুমি, বিস্মিত হয় সে।আর সেই আকাশ যদি হয় মেঘমুক্ত, তবে তো আমাদের মনোরাজ্যে ভর করে এক অপরূপ মোহময়তা। অসংখ্য তারার সোনালী ফুল যেন ফুটে রয়েছে আকাশের পটে। কিন্তু আমরা ক’জন খুব স্পষ্টভাবে জানি — কেমন করে জন্ম হলো এ তারাদের আর তাদের জীবনটাই বা কেমন? আজ তাহলে সে গল্পই জানবো আমরা।
নীহারিকার অভ্যন্তরস্থ ধূলিকণা ও গ্যাস সম্বলিত বিপুল পরিমাণ বায়ু যখন নিজস্ব মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চাপেনিজের উপরেই চুপসে যেতে থাকে, তখন একটি তারার জন্ম হয়। এ সংকোচনের সময় অতি উচ্চ চাপ ও কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়। এ সময় নিউক্লীয় ফিউশন বিক্রিয়া সংঘটিতহবার কারণে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। ফলে পদার্থের গোলকটি দীপ্তি ছড়ায়। কাজেই, তারা হচ্ছে নীহারিকার মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রচণ্ডতাপে উত্তপ্ত ও উজ্জ্বল গ্যাস-পিণ্ড। এরা অতি প্রকাণ্ড আকারের, গুরুভার এবং অস্বাভাবিক রকম বেশি তাপমাত্রা বিশিষ্ট।
কোন কোন তারার ব্যাস সূর্যের ব্যাসের প্রায় ১০০গুণ আর ভর সূর্যের ভরের ১২গুণ থেকে ৫০গুণ পর্যন্ত হয়। তারকা পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৫০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস । তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে তারাদের রঙের ভিন্নতা দেখা যায়। সবচাইতে উত্তপ্ত তারার রঙ নীল আর শীতলতম তারার রঙ হয় লাল । সূর্যেরতাপমাত্রা এই দুই তাপমাত্রার মাঝামাঝি বলে আমরা সূর্যকে হলুদ দেখি।
জন্মের পরপরই তারার উপাদান থাকে প্রধানত প্রচণ্ড-তাপে-উত্তপ্ত-উজ্জ্বল-হাইড্রোজেন গ্যাস । এ অবস্থায় তারাটি কয়েক’শ হাজার বছর কাটিয়ে দেয়। এরপর তারার কোর (Core) বা কেন্দ্রীয় মূলবস্তুতে নিউক্লীয় ফিউশন বিক্রিয়ার দ্বারা শক্তি উৎপন্ন হতে থাকে যা প্রচণ্ড তাপ ও অত্যুজ্জ্বল আলোকশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ ফিউশন বিক্রিয়ার ব্যাপ্তিকাল প্রায় ১০ মিলিয়ন বছর। যতদিন পর্যন্ত না কোরের হাইড্রোজেন সম্পূর্ণরূপে হিলিয়ামে পরিণত হয়, তারাটি ততদিন একইভাবে আলো বিকিরণ করতে থাকে। অবশেষে এ ভারী তারাটি একটি রক্তিম অতিদৈত্যে (Red Super-giant) পরিণত হয়। এ রক্তিম অতিদৈত্যের কোর বা মূলবস্তুতে থাকে লৌহ। হাইড্রোজেন নিঃশেষ হয়ে যাবার পর কোর বা মূলবস্তু সংকুচিত হতে থাকেকিন্তু বহিঃস্থ অংশ তখন প্রসারিত হতে থাকে, ফলে তারাটির ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সাথে সাথে পৃষ্ঠ-তাপমাত্রা হ্রাস পেয়ে তারাটি ক্রমান্বয়ে শীতল হতে থাকে। পরবর্তী কয়েক মিলিয়ন বছরে প্রচুর নিউক্লীয় সংঘটিত হয় এবং তারাটি এমন একটি রূপ পায় যে এর লোহাময় কোরের চারপাশে বিভিন্ন উপাদানের আস্তরণ সৃষ্টি হয়।এমতাবস্থায় কোরের সংকোচন খুব বেশি হয় বলে এর ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং মধ্যাকর্ষণজনিত চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন মধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে তারাটি আর নিজেকে বহন করতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে ঘটে এক বিস্ময়কর ঘটনা; কোরটি হঠাৎ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে (প্রায় ১ সেকেন্ডে) উচ্চ শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে এর ক্রিয়াশক্তির বিলুপ্তি ঘটায় ও বাড়তি ওজন হারায়। একেই বলে সুপারনোভা (Supernova) বিস্ফোরণ।
একটা গোটা ছায়াপথের আলোর চেয়ে বেশি উজ্জ্বলতা নিয়ে একটা সুপার নোভা অল্প সময়ের জন্য জ্বলে ওঠে। কখনও যদিসুপার নোভা বিস্ফোরণের পরও কোরটি দৈবাৎ টিকে যায় এবং টিকে যাওয়া কোরেরভর যদি সূর্যের ভরের দেড় থেকে তিন গুণের মধ্যে হয় তবে তা খুবই সংকুচিত হয়ে অতীব ঘনত্ব ও ক্ষুদ্র আয়তন বিশিষ্ট নিউট্রন তারকায় (Neutron Star) পরিণত হয়। Red Super-giant এরব্যাস যেখানে ছিল প্রায় ১০০ মিলিয়ন কিলোমিটার (১০০০০০০০০ km), সেখানে একটি নিউট্রন তারকার ব্যাস কমে এসে দাঁড়ায় প্রায় মাত্র ১০ কিলোমিটারে (১০ km)। নিউট্রন তারকার ঘনত্ব এতই বেশি যে এর অভ্যন্তরস্থ পদার্থের এক চা-চামচ পরিমাণের ওজন প্রায় ১ বিলিয়নটন (১০০০০০০০০০ টন)।
আর সুপার নোভা বিস্ফোরণের পর টিকে যাওয়া কোরের ভর সূর্যের ভরের তিনগুণ অপেক্ষা বেশি হলে তখন কোরটি অনির্দিষ্টভাবে সংকুচিত হতে থাকে এবং এর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এতো ভয়াবহ রকম বৃদ্ধি পায় যে, কোরটি তার প্রভাবযুক্ত অঞ্চলে উপস্থিত সকল পদার্থকে এমনকি আলোককেও প্রচণ্ডভাবেআকর্ষণ করে নিজের মধ্যে বিলীন করে ফেলে। ফলে সেখান থেকে আলোও ফিরে আসতেপারে না। তখন এ তারাটি রূপান্তরিত হয়মহাবিস্ময়ের আধার “ কৃষ্ণগহ্বর ” বা Black Hole -এ।
কোন বস্তুতে আলো পড়ে, সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে ফিরে এলে (অর্থাৎ , প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসে আমাদের চোখের রেটিনার আলোক সংবেদী কোষে আঘাত করলে) তবেই আমরা বস্তুটিকেদেখতে পাই। কৃষ্ণগহ্বর এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটায় বলে আমরা কৃষ্ণগহ্বরকে চোখে দেখি না। শুধুমাত্র যখন এ মহাখাদক ভোজনে রত হয়, তখনই তার অস্তিত্ব বুঝতে পাড়া যায়। তবে বুঝতে পারার জন্য এ ভোজ পর্বে ভোজ্য বস্তুটি অবশ্যই হতে হবে “আলো”। কেননা, কৃষ্ণগহ্বর যখন আলোকে উদরস্থ করতে থাকে, তখন কৃষ্ণগহ্বরের চতুর্দিকে আলোর ঘূর্ণায়মান বলয় তৈরিহয় যা অনেকটা মশার কয়েলের আকৃতির।
ক্রমে বিলুপ্ত এ ঘূর্ণায়মান আলোর বলয় নিজেকে উৎসর্গ করতে করতে যেন আমাদের বলে যায়, “ওগো মানুষেরা ! তোমরা যাকে “কৃষ্ণগহ্বর” বলো, সেই সর্বনাশা মহাখাদকের অবস্থান এখানটাতে … … …
No comments:
Post a Comment